সুকৌশলে বিনষ্ট হওয়া দেশের কর্ণধার সম্প্রদায়

-> বাংলাদেশ। নামটি শুনলে হৃদয়ে যতটা প্রেম জাগ্রত হয় তা মনে হয় সেই বহুকাল পূর্বের কোন এক সময় এর কাল্পনিক কোন এক শ্রুতি বাক্য। মনে প্রশ্ন জাগে, সেই প্রেম কি ১৭৫৭ সালের সিরাজ-উদ-দৌলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল? এখনো কি সেই প্রেম বর্তমান আছে আমাদের মাঝে? নাকি আমরা তথাকথিত দেশপ্রেম নিয়ে মাতামাতি করি!! সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া বড্ড দায়।

-> ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হল। আহা! দেশ স্বাধীন হল। আমার দেশ। আমাদের দেশ। নতুনভাবে শুরু হল পথচলা। সেই পথচলার ৪২ বছর পরে এলো নতুন এক অধ্যায়। নাম আধুনিকতা। আহ! আধুনিকতা শব্দটা তো গেঁয়ে শব্দের বিপরীত। এখন তো আর এসব শব্দ চলে না। বলা উচিত আধুনিকতা শব্দটা তো ব্যাকগ্রাডেড শব্দের বিপরীত। তো কি সেই আধুনিকতা? সামাজিক যোগাযোগ এর যুগান্তকারী উপাদান ফেসবুক। আধুনিক হতে গেলে ফেসবুকসহ অন্যান্য একাউন্ট থাকাটা অলিখিত দলিল।

-> বুয়েট থেকে পাশ করা ছেলেটা আজ আমেরিকা চলে গেছে। সে নাকি বছরখানেক আগে সেখানে সরকারি স্কলারশিপ পেয়েছিল। তারপর শোনা গেল সে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এর খুব ভাল পদে চাকরি পেয়েছে একজন দক্ষ কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তার পরিবারকেও নিয়ে গেছে। তার তো কোন চিন্তা নাই। ভাল চাকরি, ভাল বেতন, সাহিত্য বিশারদদের মতানুসারে ছান্দিক সুখময় সুখের সংসার।

-> দুর্নীতি। তিনি সরকারি চাকরি করেন। উচ্চ পদে আছেন। নিশ্চিত তিনি দুর্নীতিবাজ। নাহলে কি তিনি উচ্চ পদে থাকতে পারতেন? কখনই না। সংবিধান এ এরকম কোন লিখিত সংজ্ঞা আছে বলে তো মনে হয় না।

-> আহা! কত আনন্দের খবর। পরিবারে নতুন শিশু এসেছে। বছর ৩ না ঘুরতেই ছেলেটা ৬ মিনিটে ১০০ শত্রু সেনা খতম করতে ওস্তাদ। আমাদের দেশের সেনারা যে কি করে!! এসব ওস্তাদ, মহাভারতের ভীম এর ন্যায় ক্ষত্রিয়দের থেকে কিছু শিখলেও তো পারে। বলছিলাম পাবজি এক্সপার্ট ভীম এর ন্যায় যোদ্ধাদের কথা।

এই কথাগুলো আমার কথা না। এই কথাগুলো হল হীমাদ্রি নদীর তীরে বসে থাকা একজন দেশপ্রেমিক সত্বার আক্ষেপ এর কথা। তার নাম সুকুমার। জন্ম হয় হীমাদ্রি নদীর মাঝে কোন এক স্রোতের ওপর। অবিরাম পথচলার মাধ্যমে স্রোতের মত সেও পুরো দেশ ঘুরে বেড়ায়। লোকে বলে পথিক সুকুমার। তার বয়স আনুমানিক সহস্র বছর।

বিজ্ঞসমাজের গুরু সুকুমার একবার কথা শুরু করলে আর থামতেই চায় না। তো তার সাথে যখন সাক্ষাত হল নদীর তীরে তখন বললাম, আপনার সাক্ষাত এর অপেক্ষায় কত ঘুরেছি। আজ দেখা হল; অনেক কথা বলব আজ আপনার সাথে।
প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কেমন আছেন? বলে কি সে নাকি ভাল নাই। কারন জিজ্ঞাসা করায় সে বলে কিভাবে ভাল থাকা যায়!! দেশের মানুষের মাঝে দেশপ্রেম এর যে স্বল্পতা, তরুন সমাজ এর যে ভঙ্গুর দশা, আধুনিকতার নামে যে করুন দশা তাতে কি ভাল থাকা যায়?? মহাশয় আমি বুঝছি না। একটু বিস্তারিত বলেন। তিনি বললেন,শোন তাহলেঃ-
১৭৫৯ সাল। সিরাজ এর মৃত্যুর বছর পার হয়েছে। মীর জাফর বোঝা শুরু করেছে শাসন এর পুরো ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাতে। সে শুধু নামমাত্র রাজা। তখন সে আফসোস ছাড়া আর কোন কাজ করার সময় সুযোগ পেত না। তো সেই যে শুরু হল আফসোস সেটা এখন প্রতি বাঙ্গালির নিজস্ব সম্পদ। একটা কাজ শুরু করবে একজন। আহ! আজ না। কাল থেকে শুরু করব। কাল আর আসে না কখন। আফসোস। একটা ব্যবসা শুরু করতে হবে। পরিকল্পনা আগে করতে হবে। সেই পরিকল্পনা শেষ হলে দেখা যায় সেটা অন্য দেশে ২০ বছর আগে হয়ে গেছে। আফসোস। এত এত আফসোস !! ধুর! ভাল লাগে না। ইন্টারনেট অন, লগ ইন, শুরু স্ক্রলিং।

->বুয়েট থেকে পাশ করল। ভাল কথা। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এ কাজ করার সুযোগ পাইল। পরিবার নিয়ে চলে গেল। ২৫ বছর দেশের সম্পদ ব্যবহার করল। অথচ সে দেশের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করল না। কি দরকার। আপন প্রান আগে। বেঈমান।

->অন্যকে দুর্নীতিবাজ বলার আগে নিজে চিন্তা করো নিজে দুর্নীতিবাজ কি না। একজন ছাত্র যদি ঠিকমত বিদ্যা না অর্জন করে তাহলে কি সেটা দুর্নীতিবাজ না? সেটা তো আর বড় দুর্নীতি। কারন ছাত্র নিজের কর্তব্য এর সাথে বিরোধিতা করল। কিসের ছাত্রত্ব, দুর্নীতিবাজ।

->ছোট বাচ্চা। খেলবে। প্রকৃতির সাথে থাকবে। প্রকৃতি দেখবে,প্রকৃতি তাকে শিখাবে সব। তাকে যুদ্ধ করতে বলেছে কে?সেই যুদ্ধগুলো সে যদি মোবাইল বা কম্পিউটারে না খেলে বন্ধুদের সাথে গিয়ে মাঠে খেলত তাহলে সে যেমন সামাজিকতা শিখত তদ্রুপ শারীরিক উন্নতি হত। কিন্তু পাবজি যোদ্ধা হওয়ার কারনে সে আজ সময় অপচয় করার কৌশল শেখা ছাড়া কিছুই শিখছে না। নষ্ট হচ্ছে একটা সম্ভাবনাময় বীজ যে বীজ একসময় দেশের হাল ধরতে পারত।

নাহ আমি তো বিপদে পরেছি মনে হচ্ছে। সুকুমার এর থেকে এত সব শুনতে থাকলে আমার মগজ ধোলাই হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু সুকুমার একবার যেহেতু বলা শুরু করেছে তাহলে সে শেষ না করে আর থামবে না। অগত্যা। শুনতেই হবে।
হীমাদ্রি নদীর সুপেয় পানি আর প্রকৃতির ফল আমরা ভাগাভাগি করে খাওয়ার পর আবারও সুকুমার শুরু করল কথা বলা। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে মনে হয় কেঁদে দিবে এখুনি। কথা বলার সময় সে বারবার থেমে যাচ্ছিল। কণ্ঠ ভেজা ভেজা মনে হচ্ছিল। আমি শুধু দেখছিলাম। তাছাড়া এই পদ্মভূষিত লোকালয়ের আমি সত্বার বাসিন্দার কিছুই করার ছিল না।

একটা শিশু জন্ম গ্রহন করল। পৃথিবী আনন্দিত হল। নতুন প্রানের আগমন হল। প্রকৃতি এই বীজ রোপণ করল কারন প্রকৃতি জানে এইটা সেরা বীজদের মধ্যে অন্যতম।এই যোগ্য,এই সেরা। দেশ তাকে বড় করা শুরু করল। দেশ তার আলো, বাতাস, খাদ্য দিয়ে তাকে বড় করা শুরু করল। তার মনোরঞ্জনের সকল ব্যবস্থা গ্রহন করল। তাকে খেলার জায়গা দিল। তার সকল অপূর্ণতা পুরন করল। কারন দেশ যে তার মা। মা কি সন্তানের জন্য সকল খুশির যোগান না দিয়ে পারে? শিশুটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল। সে অনেক বড় হয়ে গেল। কতটুকু বড়? মা এর কাছে সন্তান কি কখন বড় হয়? সে তো মা এর কাছে সেই আগের মত ছোটই আছে। মা তখনও তাকে লালন পালন করছে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কি মা দেশ মা তাকে লালন পালন করবে না? মা কি কখনও বলবে আজ থেকে সন্তানকে আর দেখাশোনা করবে না? সুকুমার আর বলতে পারল না। তার কান্না দেখে মনে হল প্রকৃতি স্থির হয়ে গেছে। পাখিরা ওড়া ভুলে গেছে। নদীতে আর স্রোত চলছে না। সবাই শুধু সুকুমারকেই দেখছে।
কান্না থামিয়ে সুকুমার আবার বলা শুরু করল।ওই শিশুকে দেশ মা যে বড় করল, তার কি বিন্দুমাত্র দায়িত্ব নাই মা এর ওপর? এটাকে দায়িত্ব বলা ভুল হবে। মা এর ওপর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাকে কে অধিকার দিল দেশের সাথে প্রতারনা করার?সুকুমার কে দেখে এবার একটু গর্জিত মনে হচ্ছিল। চোখে রক্তের আভা। সে এবার যা যা বলছে সব যেন হৃদয়ে বিদ্ধ হচ্ছিল। তার কথাগুলো ছিল এরুপঃ

শিশু জন্ম নিল। তার শুরু হল নতুন পথচলা। যখন সে একটু বড় হল তখন তার স্কুলে যাওয়ার কথা। বন্ধুদের সাথে মাঠেখেলার কথা। সে শুধু শিখবে।প্রকৃতি তাকে শেখাবে। সে কেন মোবাইল হাতে নিয়ে বন্ধ রুমে বসে গেম খেলবে? এটা কি সময় এর অপচয় ছাড়া আর কিছু? এটা থেকে সে কি শিখবে? মনোরঞ্জন? কেন প্রকৃতি তার মনোরঞ্জনের জন্য কোন ব্যবস্থা করেনি? গাছ,নদী,পশুদের বৈচিত্র্য এসব দেখতে গেলে তার জীবন এর অন্তিমকাল চলে আসবে অথচ এসব বৈচিত্র্য দেখা শেষ হবে না!! অথচ সে কোন ভ্রান্ত পথের মধ্যে থেকে নিজের জীবনের সোনালি সময় গুলোকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে? এটা কোন ধরনের আধুনিকতা?

ছাত্র অবস্থায় সে কি করবে? বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র। এই কবিতা তো আজ মান্ধাতার। আধুনিক না। তাই এর মর্ম বুঝতে না পেরে ছাত্র ভুলে যায় তার কর্ম সম্পর্কে। সে আজ ব্যস্ত কম্পিউটার নিয়ে। গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত যাতায়াত!! হায়রে আধুনিকতা! অথচ কখনো কি পায়ে হেঁটে সেই ছাত্র খোঁজ নিয়েছে তার বাড়ির পাশের বৃদ্ধলোকটি হাঁটতে পারছে না, তার কি অবস্থা এখন? প্রচণ্ড জ্বরে কাতরানো তার বন্ধু ২ দিন স্কুলে যায়নি,তার কি অবস্থা এখন? ইদের দিন নতুন পোশাক কিনতে না পেরে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা তার গরীব বন্ধুর জন্য কি করা যায়, সবাই মিলে একটা নতুন পোশাক উপহার দেয়া যায় কি না? নাহ এটা তো বাকগ্রেডেড চিন্তা, আধুনিক হও,ইন্টারনেট অন, লগ ইন, শুরু স্ক্রলিং। আধুনিক সামাজিকতার যুগে প্রবেশ।

বুয়েট থেকে পাশ করা ছেলেটা তো দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান সন্তানদের একজন। সে আরো বিদ্যা অর্জনের জন্য বিদেশ গেল। তারপর ভাল চাকরি পেল। সেখানেই সে বাকি জীবন অতিবাহিত করার মনোনিবেশ করল। সে কি একবারও চিন্তা করতে পারল না সে দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাকে দেশের কত প্রয়োজন। সে এই প্রয়োজন এর প্রয়োজনীয়তা বুঝল না? দেশ তাহলে কিভাবে সানে যাবে? দেশকে নেতৃত্ব দিবে কে?দেশের সেরা সন্তান তো আজ নিজের লাভের জন্য বিদেশ পরে আছে। দেশ মাএর যা হওয়ার হবে। অন্যজন দেখবে দেশ।আমার কি? হায়রে সন্তান!! কি সব আধুনিকতা!!

দুর্নীতি। নিজের ক্ষমতার অপব্যহারই তো দুর্নীতি। এটা কতক সরকারি কর্মচারীদের মাঝেশুধু সীমাবদ্ধ।আরে বোকা!! তাদের চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ তো আপনি নিজে। লেখাপড়া করা, সেটা ঠিকমত করা হয় না, ছাত্র দুর্নীতি। লেখক, সংকীর্ণ মনের লেখা, পাঠকদের সাথে দুর্নীতি। চালক, লাইসেন্স নাই, যাত্রীদের সাথে দুর্নীতি। দারোয়ান, ঘুমিয়ে পরে পাহারা দেয়ার সময়,মালকিনের সাথে দুর্নীতি। আরো কত উদাহরন!! সরকারি কোন কর্মচারী দুর্নীতিবাজ হলে নিজ দায়িত্বে অবহেলা করা এসব জনগন, ছাত্ররা হল দুর্নীতির জনক। সুতরাং আগে নিজে ঠিক হওয়া উচিত। পরে অন্যের দোষ খোঁজ করা উচিত। নিজের কাজে সচেতন হলেই তবেই দেশ এর উন্নতি এর আশা করা উচিত। সবাই অন্যের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত।এটা তো দেশ শিক্ষা দেয় নি। ভুলে গেছিলাম, এসব তো মান্ধাতার, ব্যাকগ্রেডেড, আসো আধুনিকতাই। ইন্টারনেট অন, লগ ইন, শুরু স্ক্রলিং।

এত সব কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমার যদি ডানা থাকত তাহলে উড়ে যেতাম। এসব শুনতে থাকলে মগজ ধোলাই হবে নিশ্চিত। সুকুমার তো কোন ভাবেই থামছে না। আরও কিছু বলতে যাবে সুকুমার… এমন সময়উচ্চ আওয়াজ… ক্রিং ক্রিং ক্রিং…ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে মনে হল মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙল আধুনিক অ্যালার্ম নামক মোরগ এর ডাকে। তারপর কি যেন মনে হল, আরে সুকুমার এর কথা ভেবে লাভ কি… ওই সব সোশিয়ালিস্টিক কথা। স্বপ্নের কথা। ওইগুলো অন্য কেও ভাববে্‌, আমার কি দরকার!! ইন্টারনেট অন, লগ ইন, শুরু স্ক্রলিং……

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. শামস আল গালিব : ০১-০৬-২০২০ | ২৩:০৩ |

    অসাধারণ লেখা… 

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০২-০৬-২০২০ | ০:০০ |

    ভীষণ ভালো লাগলো লেখা ।

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুরুব্বী : ০৩-০৬-২০২০ | ১৯:১৩ |

    ভাবনা গুলোনকে বেশ গুছিয়ে প্রকাশ করেছেন। ভালো থাকবেন নিরাপদে থাকবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...